স্ট্যান লি: মার্ভেলের অরিজিনাল সুপারহিরো
ষাটের দশকের শুরুর দিকের ঘটনা। সারা দিনের কাজ শেষে বাসায় ফিরেছেন স্ট্যান লি। ফ্রেশ হতে হতে স্ত্রীকে বললেন, ‘কী যে ছাইপাশ লিখি এসব! আজকাল এসব কেউ পড়ে? ভাবছি, চাকরিটা ছেড়েই দেব।’ স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে আঁতকে উঠলেন জোয়ান। ছোটবেলা থেকে যে কমিকস তাঁর জীবন-মরণ, সেই কমিকস ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন? স্ত্রীর অনুরোধে শেষ একটা কমিকস লেখার পণ করলেন স্ট্যান লি। ফ্যান্টাস্টিক ফোর কমিক বুক ইতিহাসের চিত্র পাল্টে দেওয়া এক পরিবারের গল্প।
স্ট্যান লির জন্ম ১৯২২ সালে নিউইয়র্কের নিম্নমধ্যবিত্ত এক পরিবারে। পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল স্ট্যানলি মার্টিন লিবার, কমিকসের জগতে আসার পর ‘স্ট্যান লি’ নামেই তাঁকে চিনেছে সবাই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী ‘গ্রেট ডিপ্রেশন এরা’য় বেড়ে উঠেছেন স্ট্যান; তাই ছোটবেলা থেকেই ক্ষুধা, মন্দা, বেকারত্ব, হতাশা—সবই খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। তাঁর বয়সী ছেলেরা যখন কলকারখানায় কাজ করতে ব্যস্ত, তখন মায়ের উৎসাহে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ জন্মায় তাঁর। পারিবারিক অশান্তির মধ্যে বড় হওয়া স্ট্যান লি দুদণ্ড শান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন বইয়ের মধ্যে।
চাকরির বাজারে নেমেই কাজে আসে বই পড়ার অভ্যাস। স্কুলের গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই টাইমলি কমিকস-এ জো সাইমন ও জ্যাক কার্বির সহকারী হিসেবে কাজের সুযোগ পান স্ট্যান লি। ক্যাপ্টেন আমেরিকা কমিকস দিয়ে সাইমন-কার্বি জুটি তখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে ক্যাপ্টেন আমেরিকার জনপ্রিয়তা তখন আকাশচুম্বী, এমনকি যুদ্ধের ময়দানের দেদার বিক্রি হতো ক্যাপ্টেন আমেরিকার কমিকস। চাকরিতে যোগদানের তিন মাসের মাথায় ক্যাপ্টেন আমেরিকা’র ৩ নম্বর ইস্যুতে স্ট্যান লিকে লেখার সুযোগ করে দেন জো সাইমন। স্ট্যান লির স্বপ্ন ছিল উপন্যাস লেখার, কমিকসের পাতায় তাই নিজের আসল নামটা প্রকাশ করার কোনো ইচ্ছাই ছিল না তাঁর। তাই তো আসল নামকে কাটছাঁট করে লেখক হিসেবে জুড়ে দেন ‘স্ট্যান লি’। রাতারাতি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যান স্ট্যান লি। কিন্তু বাদ সাধে মার্কিন সেনাবাহিনী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ডাক পড়ে তাঁর।
তত দিনে টাইমলি কমিকসে লেখক থেকে পদোন্নতি পেয়ে এডিটর হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন স্ট্যান লি। সেনাবাহিনীতে স্ট্যান লির দায়িত্ব ছিল কমিউনিকেশনের যন্ত্রপাতি নিয়ে, যে কারণে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করতে হয়নি তাঁকে। বরং যুক্তরাষ্ট্রে থেকেই নিজের দায়িত্ব আর লেখালেখি—দুটোই চালিয়ে যান তিনি। কিছুদিন পন ট্রেনিং ফিল্ম ডিভিশনে তাঁকে বদলি করা হয়। এর বাইরে প্রতি সপ্তাহে চিঠিতে নিজের গল্প লিখে পাঠাতেন স্ট্যান আর টাইমলি কমিকস সেটাই ছাপত তাদের পাতায়। কমিকস সময়মতো পাঠাতে গিয়ে আরেকটু হলেই সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত হতে পারতেন তিনি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর কমিকসের চাহিদা আস্তে আস্তে কমতে থাকে পাঠকদের মন থেকে। পঞ্চাশের দশকে নিজেদের সঙ্গে লড়াই করেই টিকে ছিল কমিক বুক ইন্ডাস্ট্রি। দুর্দিনে সুযোগ বুঝে অনেক লেখক নিজেদের পেশাও বদলে ফেলেন। অবশেষে ষাটের দশকের একদম শুরুতে নতুন চিন্তা খেলে যায় তাঁর মাথায়। সুপারহিরো চরিত্রদের ‘সুপার’ না দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাতারে নামিয়ে আনলে কেমন হয়? রোমান্টিক, অ্যাকশন কিংবা কমেডি—সব জনরা থেকেই দর্শকেরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তাই সেখান থেকে সরে এসে তিনি বললেন এক পরিবারের গল্প। জ্যাক কার্বির সঙ্গে মিলে ১৯৬১ সালের ১ নভেম্বর প্রকাশ পায় ফ্যান্টাস্টিক ফোর-এর প্রথম ইস্যু। রোমান্স-অ্যাকশন-কমেডির আড়ালে লুকিয়ে ছিল মিস্টার ফ্যান্টাস্টিক, ইনভিসিবল গার্ল, দ্য থিং আর হিউম্যান টর্চের ছোট্ট এক পরিবারের গল্প।
ফ্যান্টাস্টিক ফোর–এর সাফল্যের পর বদলে যায় লির ভাগ্যের চাকা। পুনরায় প্রকাশক মার্টিন গুডম্যানের সুনজরে পড়েন তিনি। ফলে নিজের চরিত্রগুলোর গল্প নিজের মতো করে বলার সুযোগ হয় তাঁর। পরের বছরই স্টিভ ডিটকোর সঙ্গে মিলে তৈরি করেন স্পাইডার-ম্যান। প্রথমবারের মতো সুপারহিরো হিসেবে কমিক বুকের প্রচ্ছদে জায়গা করে নেয় কোনো টিনএজ চরিত্র। এর আগে পর্যন্ত টিনএজ চরিত্রের দৌড় সীমাবদ্ধ ছিল সাইডকিক পর্যন্তই। স্পাইডার-ম্যানের সাফল্য স্ট্যান লিকে পৌঁছে দেয় অনন্য এক উচ্চতায়৷ একে একে স্ট্যান লির কলমের ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে ওঠে থর, হাল্ক, আয়রন ম্যান, ডক্টর স্ট্রেঞ্জ, এক্স–মেন-এর মতো চরিত্র। ষাট ও সত্তরের দশকে কমিকসের স্বর্ণযুগের পুরোটাজুড়েই ছিল স্ট্যান লির জয়জয়কার। প্রথমবারের মতো ডিসি কমিকসের সঙ্গে পাল্লা দিতে শুরু করে মার্ভেল।
স্ট্যান লির মাস্টারস্ট্রোক ছিল তাঁর গল্প বলার ধরনে। অন্য লেখকেরা যখন ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ সুপারহিরো চরিত্র তৈরি করতে গিয়ে তাদের হাতে তুলে দিতেন ঐশ্বরিক ক্ষমতা, সেখানে স্ট্যান লি সুপারহিরোদের নামিয়ে আনতেন সাধারণ মানুষের কাতারে। দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা, সম্পর্কের টানাপোড়েনের মতো বিষয়াদি নিয়মিতই উঠে এল তাঁর গল্পে। এ কারণে কমিক বুকের চরিত্র হয়েও স্পাইডার-ম্যান, আয়রন ম্যানদের খুব সহজেই আপন করে নিতে পারতেন পাঠকেরা। সমসাময়িক সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়াদিও খুব স্বাভাবিকভাবে উঠে আসত তাঁর কমিকসের পাতায়। তাঁর হাত ধরে কমিকসের পাতায় অভিষেক হয়েছে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ সুপারহিরো ব্ল্যাক প্যানথারের। কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আদায়ের দুই নেতা মার্টিন লুথার কিং ও ম্যালকম এক্স থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করেন প্রফেসর এক্স ও ম্যাগনিটোর চরিত্র। যে কারণে সব শ্রেণির পাঠকই কাউকে না কাউকে পেতেন নিজের সঙ্গে মেলানোর মতো।
১৯৭২ সালে মার্ভেলের প্রকাশক পদে আসীন হন স্ট্যান লি। আস্তে আস্তে নিউইয়র্ক থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসে যাতায়াত শুরু হয় তাঁর। আর সেখানে এসেই খোঁজ পান নতুন এক স্বর্ণের খনির, নাম তার হলিউড। আস্তে আস্তে হলিউডের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে মার্ভেলের চরিত্রগুলোকে হলিউডে আনার চেষ্টাচরিত শুরু করেন তিনি। প্রথমে টেলিভিশনের পর্দায়, এরপর বড় পর্দায় অভিষেক হয় মার্ভেলের বিখ্যাত চরিত্রগুলোর। হাল্ক ও স্পাইডার-ম্যানের হাত ধরে হলিউডে অভিষেক হয় মার্ভেলের। কিছু সময়ের জন্য মার্ভেলের প্রেসিডেন্ট পদেও আসীন হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সিটে বসে নম্বর কপচানোর চেয়ে গল্প লেখাতেই তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি। যে কারণে কয়েক মাসের মাথায় আবারও প্রকাশক পদে ফিরে আসেন তিনি। অবশেষে ২০০১ সালে মার্ভেল কমিকস থেকে অবসর নেন তিনি। মার্ভেল থেকে বিদায়ের পর কিছু সময়ের জন্য ডিসি কমিকসেও অতিথি লেখক হিসেবে লিখেছেন এই কিংবদন্তি।
তবে তিনি মার্ভেল ছাড়লেও মার্ভেল তাঁকে ছাড়েনি। মৃত্যুর আগপর্যন্ত মার্ভেলের প্রচারিত প্রতিটি মুভি, টিভি শো কিংবা অ্যানিমেটেড সিরিজে ক্যামিও চরিত্রে দেখা মিলত স্ট্যান লির। তাঁর ক্যামিও হলিউডে এতটাই বিস্তার করেছিল যে প্রতিদ্বন্দ্বী ডিসির মুভিতেও তাঁকে দেখা যেত কালেভদ্রে। ২০১৭ সালে স্ত্রী জোয়ান বুককের মৃত্যুর পর থেকেই জনসমক্ষে আসা কমিয়ে দেন স্ট্যান লি। ২০১৮ সালের ২০১৮ সালের ১২ নভেম্বর লস অ্যাঞ্জেলেসে পরলোক গমন করেন কমিক বুক ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী চরিত্র।
0 comments:
Post a Comment